সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বিছট গ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধের ভাঙন পয়েন্টে দুই দিনেও বিকল্প রিং বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতির ভয়াবহতা ঠেকাতে ভাঙন পয়েন্টে দ্রুত বিকল্প রিংবাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে একজন ঠিকাদার নিয়োগ করা হলেও তিনি এখনও কাজ শুরু করতে পারেননি।
ফলে খোলপেটুয়া নদীর সাথে তাল মিলিয়ে ভাঙনকবলিত এলাকার ছয়টি গ্রামে নিয়মিত জোয়ার ভাটা হচ্ছে। এতে করে পানি বন্দি হয়ে পড়েছে ওইসব গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে সহস্রাধিক চিংড়ি মাছের ঘের ও বোরো ধানের ক্ষেতসহ ফসলি জমি। ডুবে গেছে গ্রামগুলোর নিম্মাঞ্চলের পুকুর। পানি উঠছে বসতবাড়িতে, ভেঙে পড়েছে কাঁচা ঘরবাড়ি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মাছের ঘেরে নদীর লবণ পানি প্রবাহের জন্য বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে তলা দিয়ে পাইপ বসানোর কারণে বাঁধের নিচের মাটি দুর্বল হয়েছিল। যে কারণে আস্তে অস্তে তলার মাটি ক্ষয়ে যাওয়ায় হঠাৎ করে বেড়িবাঁধ ধসে পড়ে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার (১ এপ্রিল) বিছট গ্রমের ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শনে আসেন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিষ্ণপদ পাল, পাউবো খুলনা অঞ্চলের তত্ত্ববধায়ক প্রকৌশলী সৈয়দ শহিদুল আলম, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শাখাওয়াত হোসেন, আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কৃষ্ণা রায় প্রমুখ।
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ৯টার দিকে সরেজমিনে বিছট গ্রামের ভাঙন পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে বেড়িবাঁধের ভাঙন পয়েন্ট দিয়ে প্লাবিত এলাকার পানি নামছে খোলপেটুয়া নদীতে। পানির স্রোতের সাথে ভাঙছে ল্যান্ড সাইডের ভূমি। স্থানীয় উদ্যোগে কয়েকশ মানুষ ভাঙন পয়েন্ট থেকে বেশ কিছু দূরে মাটি ও বালির বস্তা দিয়ে রিং বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের পক্ষে মাইকিং করে জানানো হচ্ছে আগামীকাল বুধবার সকাল সাতটার মধ্যে প্রতিটি বাড়ির নারীরা বাদে পুরুষদের বাঁধ সংস্কারে অংশ নেওয়ার জন্য। এদিকে দুপুরের জোয়ার শুরু হলে ভাঙন পয়েন্ট দিয়ে ফের প্রবল বেগে পানি ঢোকা শুরু করে লোকালয়ে। ফলে আরও নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভয়ে বিছট গ্রামের অনেকে গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। মাটির ঘর ভেঙে পড়া আশংকা অনেকে মালপত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন। মঙ্গলবার দুপুরের জোয়ারে প্লাবিত গ্রাম গুলোর নিম্নাঞ্চলের অনেক বাড়িতে নতুন করে পানি উঠেছে। তলিয়ে গেছে অনেক মিষ্টি পানির পুকুর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিছট গ্রামের একজন বাসিন্দা বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও পাউবো কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার কারণে ভাঙন মেরামতের কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। কিভাবে কাজ শুরু করলে দ্রুত ভাঙন প্রতিরোধ করে একটি বিকল্প রিংবাঁধ নির্মাণ করা যাবে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষ ফলে বিডম্বনা দির্ঘায়িত হচ্ছে ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের।
বিছট নিউ মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আবু দাউদ জানান, বিছট গ্রামের যে স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙেছে, ওই স্থানটি দীর্ঘদিন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এছাড়া মূল যে পয়েন্টটি ভেঙেছে সেখানে একটি পাইপ লাইন ও গেট সিস্টেম ছিল। মাছের ঘেরে পানি তোলার জন্য পাউবো’র বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে পাইপ বসিয়ে পানি তোলার কারণে হঠাৎ বাঁধটি ধসে যায়।
তিনি আরো বলেন, সোমবার ঈদের নামাজের বেলা পৌনে ৯টার দিকে গ্রামবাসী জানতে পারেন, হঠাৎ বাঁধটি ধসে পড়েছে। আমরা গ্রামের কয়েকশ লোক দ্রত ভাঙন পয়েন্টে পৌছে বাঁধটি সংস্কারের চেষ্টা করি। কিন্তু দুপুরের জোয়ারের সময় সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ভাঙন পয়েন্ট দিয়ে দ্রুত বেগে পানি ঢুকতে থাকে লোকালয়ে। বিদ্যালয়ের মাঠে খোলপেটুয়া নদীর পানি প্রবেশ করেছে।
আবু দাউদ বলেন, তাঁর বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রে। ১০ এপ্রিল থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু। দ্রুত বাঁধ সংস্থার করা না গেলে তাঁর বিদ্যালয়ে পরীক্ষা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
আনুলিয়া ইউপির চেয়ারম্যান মো. রুহুল কদ্দুস জানান, বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় গতকাল তাঁদের নির্ঘুম রাত কেটেছে। ঈদে তাঁর ইউনিয়নের মানুষ আনন্দ উপভোগ করতে পারেনি। ইতিমধ্যে বিছট, বল্ল¬ভপুর, আনুলিয়া, চেঁচুয়া, কাকবাসিয়া গ্রামের নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সম্পূর্ন প্লাবিত হয়েছে নয়াখালী গ্রাম। এসব গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। সহা¯্রাধিক মাছের ঘের ভেসে গেছে। বোরো ধানের খেত তলিয়ে গেছে। ভেঙে পড়েছে কাঁচা ঘর ভেঙে পড়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, এখানকার ভাঙন খুবই ভয়াবহ। দ্রুত মেরামত করতে না পারলে আরো বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে। বেড়িবাঁধ ভাঙনের কথা জানতে পেরে আমি সাথে সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দ্রুত তা মেরামতের নির্দেশ দেই। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দু’টি বিভাগকে সমন্বয় করে একসাথে কাজ করতে বলেছি। আপাতত জিও ব্যাগ দিয়ে প্রটেকশন দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আমরা দ্রুত বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করছি। এসব বাঁধ তদরকির ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় মৎস্যচাষিরা ইচ্ছেমতো বাঁধ কেটে পাইপ ঢুকিয়ে পানি তুলেছেন। এ কারণে দুর্বল বাঁধ আরও দুর্বল হয়ে ধসে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের খুলনা অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সৈয়দ শহিদুল আলম বলেন, এখানে বাঁধের অবস্থা আগে থেকেই ঝুকিপূর্ণ ছিল। এছাড়া এখানে মাটির গুনগত মান খুব খরাপ হওয়ায় তা ভেঙে গেছে। দ্রুত ভাঙন মেরামতের জন্য যশোরের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ব্রাউন ফিল্ডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ঠিকাদার কাজ শুরু জন্য ইতিমধ্যে প্রয়োজনী সামগ্রী ভাঙন পয়েন্টে নিয়ে এসেছেন। আশা করছি আগামীকাল কাজ শুরু করা যাবে।
প্রসঙ্গত, গত সোমবার (৩১ মার্চ) সকাল পৌনে ৯ টার দিকে পাউবো বিভাগ-২ এর আওতাধীন ৭/২ পোল্ডারের বিছট গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে আব্দুর রহিম সরদারের ঘেরের বাসার পাশ থেকে প্রায় দেড়’শ ফুট এলাকা জুড়ে বেড়িবাঁধ হঠাৎ করে খোলপেটুয়া নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। নদীর পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়ে আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট, বল্লভপুর, আনুলিয়া, নয়াখালী চেঁচুয়া ও কাকবসিয়া গ্রাম। এর মধ্যে নয়াখালী গ্রাম সম্পূর্ন প্লাবিত হয়ে পড়েছে। বাকি গুলোর নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
খুলনা গেজেট/এনএম